বাংলাদেশের ৮ম বিভাগ ময়মনসিংহের কিছু কথা :





ঢাকা থেকে সড়কপথে ১২০ কিলোমিটার ও রেলপথে ১২৩ কিলোমিটার দূরত্ব ময়মনসিংহ
জেলা হতে পারে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। ময়মনসিংহে বেড়াতে এলে দিনে এসে রাতেই ফেরা সম্ভব। সারা দেশের সাথে এখানে ট্রেন, বাস ও প্রাইভেট কারে করে বেড়ানোর সুবিধা
রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ব্রহ্মপুত্র নদ, শিল্পাচার্য জয়নুলের আঁকা ছবি নিয়ে জয়নুল সংগ্রহশালাসহ বেশ কিছু দর্শনীয় এলাকা রয়েছে এ ময়মনসিংহ জেলায়। এ জেলায় বেড়াতে এলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন জমিদারদের প্রাচীন বাড়ি, জয়নুল সংগ্রহশালার নানা চিত্রকর্ম, ব্রহ্মপুত্র নদ, পুরোনো ঐতিহ্যবাহী উপকরণের জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বোটানিক্যাল গার্ডেন, জার্ম প্লাজম সেন্টার, কৃষি মিউজিয়াম, ফিশ মিউজিয়াম, আদিবাসীদের কৃষ্টি ও কালচার, মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি, ভালুকায় বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে হোটেল তেপান্তর প্রিন্সেস, ট্রি টপ চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, তেপান্তর ফিড চিকেন, তেপান্তর ফিল্ম সিটি, ফুলবাড়ীয়া উপজেলার এনায়েতপুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন আলাউদ্দিন পার্ক।

এসব নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে আসুন জেনে নিই এ জেলায় বেড়াতে আসতে হলে যোগাযোগের মাধ্যম ও কীভাবে আসবেন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ জেলায় ভ্রমণের জন্য
যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে সড়ক ও রেলপথ। সড়কপথে ময়মনসিংহ আসার জন্য ঢাকার মহাখালী থেকে গেটলগ বাসসহ সব ধরনের বাস ছেড়ে আসে। ঢাকার মহাখালী থেকে ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সরাসরি ও লোকাল বাস পাওয়া যায়। গেটলগ সার্ভিস রয়েছে এনা ,শামীম, ও সৌখিন। এসব গেটলগ সার্ভিসে জনপ্রতি বাড়া হচ্ছে ২৪০ টাকা। লোকাল ভাড়া ইচ্ছেমতো১৫০ থেকে ১০০ টাকা। তবে ভাড়া চুকিয়ে নিলে ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কমেও আসা যায়।
ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের সুপার আবু তাহের জানান, রেলপথে ঢাকার কমলাপুর থেকে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে জামালপুর কমিউটার-১, সকাল ৭টা ২০ মিনিটে তিস্তা, সকাল ৮টা ১০
মিনিটে মহুয়া মেইল, সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে অগ্নিবীণা, ১০টা ৪০ মিনিটে বলাকা, বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে জামালপুর কমিউটার-২, বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে আন্তনগর যমুনা, সন্ধ্যা ৬টায় আন্তনগর ব্রহ্মপুত্র ও রাত ৯টায় ভাওয়াল এক্সপ্রেস, আন্তনগর হাওর এক্সপ্রেস
ট্রেন ১১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে আসে। ময়মনসিংহ থেকে ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে যমুনা, ৫টায় ভাওয়াল, ৭টা ৩০ মিনিটে কমিউটার, ৯টা ২৩ মিনিটে ব্রহ্মপুত্র, ৯টা ৪০ মিনিটে ডেমু জয়দেবপুর কমিউটার, ১১টা ১৫ মিনিটে হাওর এক্সপ্রেস, ৩টা ১৫ মিনিটে বলাকা
কমিউটার, ৩টা ৩৫ মিনিটে দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার, ৫টা ২৩ মিনিটে তিস্তা, ৬টায় মহুয়া, ৭টা ১৭ মিনিটে অগ্নিবীণা ছেড়ে যায়। ট্রেনে জনপ্রতি প্রথম শ্রেণি ১৭৫ টাকা, শোভন চেয়ার ১৩০ টাকা, শোভন ১১০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। জেলার সঙ্গে প্রতিটি উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। সরাসরি ঢাকা ছাড়াও এ জেলার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে বাস/ ট্রেন যোগাযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ শহরে চলাচলের জন্য রয়েছে রিকশা,ব্যাটারিচালিত অটো, প্রাইভেট মাইক্রোবাস। ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও এটি কার্যকর নেই। সর্বক্ষেত্রেই ভাড়া চুকিয়ে নিতে হয়। শহরে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটো বেশি থাকায় যানজট বেশি।
শহরের ভেতরে ব্যাটারিচালিত অটোর ভাড়া ৫ভথেকে ২০ টাকার ভেতরে রয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় রিকশা ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা। শহরের টাউন হল মোড়ে ও ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন এলাকা থেকে প্রাইভেট/মাইক্রোবাস ভাড়া পাওয়া যায়।
ময়মনসিংহ শহরে থাকার মতোউন্নতমানের হোটেল হচ্ছে হোটেল আমির ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল আল হেরা, হোটেল মোস্তাফিজ, সিলভার ক্যাসেল, রিভার প্যালেস। আমির
ইন্টারন্যাশনালে এক্সিকিউটিভ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা থেকে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, এসি ডাবল রুম ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা, নন-এসি ডাবল ১ হাজার ১১৩ টাকা, সিঙ্গেল ৮৬১ টাকা। হোটেল আল হেরা এসি ডাবল রুম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, সিঙ্গেল ১ হাজার ২০০ টাকা, নন-এসি ডাবল ৮০০ টাকা, সিঙ্গেল ৫০০ টাকা।
হোটেল মোস্তাফিজে এসি ডিলাক্স ২ হাজার ৫০০ টাকা, এসি ডাবল ১ হাজার ৭৫০ টাকা, সেমি ডাবল ১ হাজার ৪৫০ টাকা, সিঙ্গেল ১ হাজার টাকা, নন-এসি ডাবল ১ হাজার ১০০ টাকা, সিঙ্গেল ৫০০ টাকা। তবে ডাবল রুমে ১৫%, সিঙ্গেল রুমে ১০% ডিসকাউন্ট রয়েছে।
আরো কম টাকায় থাকতে চাইলে হোটেল আসাদ, ঈশা খাঁ, নিরালায় যেতে পারেন। উন্নতমানের খাবার হোটেলের মধ্যে হোটেল খন্দকার, সারিন্দা, ধানসিড়ি, রুম থ্রি, সেভেন ইলেভেন, হোটেল মিনার ও ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব ক্যানটিন। এসবহোটেলে সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়।
তবে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে শুধু মুরগি বিরিয়ানি সরবরাহ করা হয়। শহরের ঐতিহ্যবাহী ও পুরোনো হোটেল খন্দকারে শুধু দেশীয় খাবার পরিবেশন করা হয়। হোটেলের স্বত্বাধিকারী খন্দকার শরীফ জানান, জনপ্রতি ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় দেশীয় ও
উন্নতমানের খাবার খেতে পারবেন। এ ছাড়া আরো অনেক খাবার হোটেল রয়েছে এ শহরে।
২২৫ বছরের পুরোনো ও বৃহৎ জেলা হচ্ছে ময়মনসিংহ। এখানে রয়েছে জমিদারদের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো অনেক বাড়ি। এগুলো হচ্ছেশশীলজ (মুক্তাগাছার জমিদার
সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বসতবাড়ি, বর্তমানে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ), জমিদারদের নির্মিত কাঠের তৈরি গৌরীপুর লজ (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের বাংলো), আলেকজান্ডার ক্যাসেল (মুক্তাগাছা জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর জুবলী উৎসব
পালনের জন্য নির্মিত হয় এটি), হাসান মঞ্জিল (ধনবাড়ি জমিদারবাড়ি, বর্তমানে ডায়াবেটিক হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত স্থান), ধলা জমিদারবাড়ি (ধনবাড়ি জমিদারবাড়ির বিপরীতে অবস্থিত), তাজ ভাঙা হাউজ (বর্তমানে মিন্টু কলেজ), চাকলাদার হাউজ (বর্তমানে হোমিও কলেজ), রাম গোপালপুর জমিদারবাড়ি (কালীবাড়ি রোডে সরকারি কর্মচারীদের আবাসস্থল), অঘোর বন্ধু গুহের বাড়ি (বর্তমানে ময়মনসিংহ কলেজ), মদন বাবুর বাড়ি (সরকারি জাদুঘর হিসেবে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে), মসুয়ার জমিদার বাড়ি (হরি কিশোর রায়ের বাড়ি, দুর্লভ ভবন)।
এ ছাড়া বড় বাজারে বড় মসজিদ, গৌরীপুরের বীরাঙ্গনা সখিনার মাজার, দুর্গাবাড়ি মন্দির, রামকৃষ্ণ মন্দির, মুক্তাগাছার শিবমন্দির, মহারাজারোডে কানাই-বালাই মন্দির,কোতোয়ালি থানার পাশে শিবমন্দিরসহ একাধিক জমিদার বাড়িতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/মন্দির/ উপাসনালয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্যের কারণে ময়মনসিংহকে শিক্ষানগরী বলা হয়। ১ হাজার ২৩০ একরের মনোরম পরিবেশবেষ্টিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ক্যাম্পাসেই রয়েছে বেড়ানোর মতো বোটানিক্যাল গার্ডেন, জার্ম প্লাজম সেন্টার, কৃষি মিউজিয়াম, ফিশ মিউজিয়াম, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট, কেবি স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান। একমাত্র বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশমূল্য ৫ টাকা নেওয়া হয়। আরকোথাও কোনো ফি নেওয়া হয় না।
এছাড়া ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পুরুষ ও মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজেই অয়োময় নাটকের শুটিং করা হয়। এসব স্থান দেখতে কোনো ফি দিতে হয় না। রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
সংগ্রহশালা। শনিবার থেকে বুধবার প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত, শুক্রবার দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। ১২ বছর পর্যন্ত শিশুদের জনপ্রতি ২ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ৫ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের বাহিরের নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ৭৫ টাকা ফি নেওয়া হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউসসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায় বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পার্ক। প্রতিদিনই সকাল- সন্ধ্যা পর্যন্ত এ পার্কে ঘুরে বেড়ায় শহরবাসী ও দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজন। এখানে এসে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবহমান সুন্দর্যের পাশাপাশি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি দেখা সম্ভব।
জেলার সীমান্তে রয়েছে গারো পাহাড় সমৃদ্ধ ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাট উপজেলা। ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাট উপজেলায় রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। জেলা শহরের বাহিরে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে ভালুকায় বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে হোটেল তেপান্তর প্রিন্সেস, ট্রি টপ চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, তেপান্তর ফিড চিকেন, তেপান্তর ফিল্ম সিটি। এ প্রতিষ্ঠানে পিকনিকসহ থাকা ও খাওয়ার সব ব্যবস্থাই রয়েছে। থাকার জন্য রয়েছে ৪০টি কটেজ। ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখানে খাবার খেতে জনপ্রতি ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাগে। রয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ ডিসকাউন্ট। সর্বসাধারণের জন্য দাম একটু বেশি, তবে বিত্তবানদের জন্য তেমন কিছু নয়। এখানে জনপ্রতি প্রবেশমূল্য ৬০ টাকা।
জেলা শহরের ৩৫ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ীয়া উপজেলার এনায়েতপুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন রয়েছে আলাউদ্দিন পার্ক। এখানে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নানান শিল্পকর্ম ও স্থাপনা। এখানে পিকনিকসহ থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানে জনপ্রতি প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা। জেলার ১৬ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছায় রয়েছে পুরোনো জমিদারবাড়ি ও ঐতিহ্যবাহী মন্ডা ঘর। দেশবিখ্যাত মন্ডা কার না প্রিয়। য়মনসিংহ জেলায় বেড়াতে এসে ময়মনসিংহের মালাইকারী, গুড়ের সন্দেশ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাঁটি দই, মুক্তাগাছার মন্ডা, হালুয়াঘাটের সালামের স্পঞ্জ মিষ্টি, নান্দাইলের কাঁচাগোল্লা, ফুলবাড়িয়ার আখের গুড় ও লাল চিনি, গফরগাঁওয়ের বেগুন, ভালুকার সৌদি খেজুর, শীতকালে খেজুরের গুড় ও রস, গরমে কাঁঠাল, রাজলক্ষ্মী দোকানের সাদা দই, স্পঞ্জ মিষ্টি নিতে ভুলবেন না।

You Might Also Like

0 comments